২০১৩ সালের জুনে সুসংগঠিত এ জঙ্গিগোষ্ঠীটি ‘ইসলামিক স্টেট’ নামে আত্মপ্রকাশের আগে বাগদাদী যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের সিনিয়র সিনেটর ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী জন ম্যাককেইনের সঙ্গে তার অর্ধডজন শীর্ষ জঙ্গিসহ গোপন বৈঠক করেন। তখন বাগদাদির মুখে লম্বা দাড়ি ছিল না। ওই বৈঠকে বাগদাদির সহযোগী আইএসের শীর্ষ সন্ত্রাসী মোহাম্মদ নূরও উপস্থিত ছিলেন। গোড়ার দিকের ওই গোপন বৈঠকগুলোতে মোসাদের বেশ কয়েকজন সদস্য ও আইএসপ্রধান বাগদাদি উপস্থিত ছিলেন। মার্কিন প্রচারমাধ্যম এবিসি নিউজ ও সিএনএনের একটি ভিডিও স্নাপশটে এ ছবির ব্যাপারে প্রমাণ পাওয়া গেছে।অতপর ২০১৩ সালে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ দখলে নিয়ে ইসলামিক স্টেট নাম দিয়ে খেলাফত ঘোষণা করেন বাগদাদি (সুত্রঃ রেডিও আজিয়াল ডটকম, সোশিও-ইকোনমিক হিস্ট্রি, গ্লোবাল রিসার্চ, এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসএ) গোপন নথি, পলিটিসাইট ডটকম, উইকিলিক্স, আমেরিকান ফ্রি প্রেস।)।
(০১) যেখানে সারা পৃথিবীতে ইসলামের নামে বোমা হামলা চালাচ্ছে আইএস, অথচ মসজিসমূহকে নাইট ক্লাব বানানর পরও জানালার পাশে "ইজরায়েল"কে তারা কেন হামলা করে না?
(০২) আইএস যদি সত্যিই মুসলমানদের সৃষ্টি হয় তবে তারা ফিলিস্থিনিদের পক্ষে তারা কেন তৎপর নয়?
(০৩) আমেরিকার কর্তৃক জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী ঘোষণার পরও তারা কেন সে দেশের উপর হামলা করে না?
(০৪) আইএস জঙ্গিরা যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের হাজার হাজার মসজিদ মাদ্রাসা ধ্বংস করে শেষ করে ফেলেছে সেখানে কেন তারা একটাও পুনর্নির্মাণ করেনি?
(০৫) মুসলিমদের জঙ্গি সাজিয়ে কারা ট্রিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বাণিজ্যসহ আরব বিশ্বের তেল-সোনা কে বা কারা চুরি করছে এবং অপছন্দের ব্যাক্তিদের বেছে বেছে ক্ষমতাচ্যুত করেছে বা করছে?
(০৬) স্যামুয়েল হান্টিংটনের দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন থিওরীর আগে কোন মুসলমানের আত্মঘাতি বোমা হামলার প্রয়োজন হয়নি কেনো?
(০৭) যেখানে শ্রীলঙ্কায় হামলার ১০দিন আগে সিআইএ ও "র" সতর্ক করে ছিল এবং হামলা কারা করবে তাও বলে দিল তবুও তার বিরুদ্ধে কেন চুপ ছিল শ্রীলংকা সরকার (উল্লেখ্য পুলওয়ামা হামলা, হোটেল তাজ হামলা, মুম্বাই হামলা, রাজিব গান্ধি হত্যা, ইন্দিরা গান্ধি হত্যা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ব্যাপারে ভারত কোনও দিনই নিজে দেশের কোন হামলার ব্যাপারে আগাম জানতে পারেনি)।
(০৮) ফ্রান্স ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরই কেন আইএস ফ্রান্সে দুইবার সন্ত্রাসী হামলা চালালো?
(০৯) জাপান ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরই কেন দুই জাপানি অপহৃত হলো ও আইএস তাদের হত্যা করলো?
(১০) ইন্দোনেশিয়া ফিলিস্তিনের গাজায় একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার পরই কেন আইএস জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম এই মুসলিম রাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা চালালো?
(১১) ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে বেলজিয়াম একটি বৈঠকের আয়োজন করার পরই কেন আইএস ইউরোপের এই দেশটিতে সন্ত্রাসী হামলা চালালো?
(১২) রাশিয়ার সহায়তায় বাংলাদেশ পরমাণু প্রকল্প থেকে ২০১৬ সালের ২১ জুন ‘স্থান সনদ’ বা সাইট লাইসেন্স পাওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে কেন গুলশানে হামলা হলো ফলশ্রুতিতে আর্ন্তজাতিক দালাল মিডিয়া প্রচার করলো বাংলাদেশ একটি জঙ্গী দেশ যেখানে পরমাণু প্রকল্প ঝুকিপূর্ণ?
(১৩) শ্রীলঙ্কার এই হামলায় তার প্রতিবেশী দেশটি তাদের নির্বাচনে ইসলাম বিদ্বেষী রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ইতমধ্যে ব্যবহার করা শুরু করেছে, এর অন্তরালে কে বা কারা রয়েছে?
এবার প্রশ্নের উত্তরসমূহ নিজে নিজে অনুধাবন করলে বুঝা যায় ঐসব ঘটনার অন্তরালে প্রকৃত ঘটনা কি?
প্রাচীনকাল হতেই ধর্মসমূহ কোনদিন একে অন্যের সহাবস্হানে ছিলো না, কোনদিন থাকবেও না। কারন, ধর্মের ভিত্তি হলো বিশ্বাস, কোন লজিক নয়। সহ-অবস্হানের জন্য সামান্য হলেও লজিক্যাল মিল ও লজিক্যাল কারণ থাকতে হয় যা একেবারেই অনুপস্থিত। প্রত্যেক ধর্মের লোকেরা বিশ্বাস করে যে তারা "সত্য পথে" রয়েছে এবং অন্যসকল ধর্মের লোকেরা "ভ্রান্ত পথে" আছে। ভ্রান্ত ও সত্য লজিক্যালী একমুখী নয়, বিপরিত মুখী। এতদসত্ত্বেও ইসলামে আল্লাহ তা‘আলা ঈমানের দাবিদার প্রতিটি মুসলিমকে নির্দেশ দিয়েছেন পরমতসহিঞ্চুতা ও পরধর্মের বা ভিন্ন মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে। উদাহরণস্বরূপঃ
(০১) আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তা'য়ালা এরশাদ করেন- “তারা আল্লাহ তা‘আলার বদলে যাদের ডাকে, তাদের তোমরা কখনো গালি দিয়ো না, নইলে তারাও শত্রুতার কারণে না জেনে আল্লাহ তা‘আলাকেও গালি দেবে, আমি প্রত্যেক জাতির কাছেই তাদের কার্যকলাপ সুশোভনীয় করে রেখেছি, অতঃপর সবাইকে একদিন তার মালিকের কাছে ফিরে যেতে হবে, তারপর তিনি তাদের বলে দেবেন, তারা দুনিয়ার জীবনে কে কী কাজ করে এসেছে {সূরা আল আন‘আম- ১০৮}।“
(০২)আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তা'য়ালা এরশাদ করেন- "ধর্মের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিস্কৃত করেনি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালবাসেন [ সুরা মুমতাহিনা -৮]।"
(০৩) আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তা'য়ালা এরশাদ করেন- "যে ব্যক্তি যে কোন মানুষকে হত্যা করার কিংবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ (করার শাস্তি বিধান) ছাড়া (অন্য কোনো কারণে) কেউ যদি কাউকে হত্যা করে, সে যেন গোটা মানব জাতিকেই হত্যা করলো; (আবার এমনিভাবে) যদি কেউ একজনের প্রাণ রক্ষা করে তবে সে যেন গোটা মানব জাতিকেই বাঁচিয়ে দিলো (সূরা মায়িদা-৩২)।"
(০১) মুওতার যুদ্ধে রওনার প্রাক্কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বাহিনীকে নির্দেশ দেন-"তোমরা কোনো নারীকে হত্যা করবে না, অসহায় কোনো শিশুকেও না; আর না অক্ষম বৃদ্ধকে। আর কোনো গাছ উপড়াবে না, কোনো খেজুর গাছ জ্বালিয়ে দেবে না। আর কোনো গৃহও ধ্বংস করবে না [মুসলিম : ১৭৩১]।"
(০২) একাধিক সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- "সাবধান! যদি কোনো মুসলিম কোনো অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে তার অধিকার খর্ব করে, তার ক্ষমতার বাইরে কষ্ট দেয় এবং তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক নিয়ে যায়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি তার পক্ষে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ উত্থাপন করব [আবূ দাঊদ : ৩০৫২]।"
(০৩) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ "যে মুসলিম কর্তৃক নিরাপত্তা প্রাপ্ত কোনো অমুসলিমকে হত্যা করবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ তার ঘ্রাণ পাওয়া যায় চল্লিশ বছরের পথের দূরত্ব থেকে [বুখারী : ৩১৬৬]।"
(০৪)রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে প্রথম বিচার করা হবে রক্তপাত সম্পর্কে (বুখারী,মুসলিম : ৩১৭৮)।
জঙ্গি শব্দটা ভূ-রাজনীতিক এবং কৌশলগত শব্দ, যার মূলে রয়েছে ষড়যন্ত্রকারীদের অর্থনীতি পোক্ত করা এবং মুসলিমদের বলির পাঠা বানিয়ে ফায়দা লুটা। শ্রীলঙ্কায় জঙ্গি হামলার সম্ভাব্য কারনসমূহ হলোঃ
ক) চীনা বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, স্টিং অব পালর্স বা মুক্তা’র মালার মাধ্যমে সাড়া বিশ্বকে সংযুক্ত করতে চাচ্ছে যার মুলে আছে দক্ষিণ এশিয়া। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মায়ানমার, শ্রীলংকা আছে এর মধ্যে। চীন মায়ানমারের রাখাইন, পাকিস্তানের বেলুচিস্তান এবং শ্রীলংকার হাম্বানটোটা বন্দরে চীন বিনিয়োগ করেছে। খেয়াল করলে দেখা যায় রাখাইনে রোহিঙ্গা হামলা হয়েছে, পাকিস্তানে বেলুচিস্তানে হামলা হয়েছে। আর এখন হল শ্রীলংকায়। এর মানে চীনা বিরোধী অক্ষ চাচ্ছেনা চীন দক্ষিণ এশিয়ায় তার আধিপত্য বিস্তার করুক। আগামী ২৭শে এপ্রিল, ২০১৯ শুরু হতে যাওয়া "ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড" সম্মেলনে শ্রীলংকার হামলা একটি বিশেষ বার্তা দিবে, তা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রীলঙ্কার সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে বলেছেন, "সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের কোনো দেশ ও ধর্ম নেই। জঙ্গি জঙ্গিই, সন্ত্রাসী সন্ত্রাসীই। এদের কোনো ধর্ম নেই। নেই কোনো দেশ-কাল-পাত্র।" আশংকার ব্যাপার এই যে সহসাই আগামী মে ০৬, ২০১৯ তারিখে পার্শ্ববর্তী দেশটির ফরেন সেক্রেটারি জরুরী সফরে ঢাকা আসছেন । তাদের উদ্দেশ্যও একই- বাংলাদেশকে ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ থেকে বিরত রাখা। তবে মনে হচ্ছে জননেত্রী শেখ হাসিনার কূটনীতি ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কাছে তারা ব্যর্থ হবে! তাহলে কি পরবর্তী টার্গেট বাংলাদেশ? সৃষ্টিকর্তার নিকট একটাই প্রার্থনা; ভূ-রাজনীতির এই খেলায় বাংলাদেশ বেঁচে গেলেই হবে।